আশুরা অর্থ কি। আশুরার রোজা রাখার নিয়ম। আশুরার ইতিহাস

মহররমের দশ তারিখকে সম্মানিত বলে পবিত্র আশুরা বলা। মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যয় ও শোকাবহ এই দিনটিকে কেউ দোয়া মুনাজাত আবার কেউ মাতমের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। এই দিনটি আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারীদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 


ইসলামের ইতিহাসে ৬১ হিজরি তথা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের দশই মহররম। মহররম ( আরবি)  হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মহররম শব্দটি আরবি যার অর্থ পবিত্র সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মহররম মাস পবিত্র হিসেবে গন্য। এবার ২০২২ সালের মহররম মাস শুরু হচ্ছে বাংলায় ভাদ্র মাস এবং ইংরেজি আগস্ট মাসে।

পোস্ট সূচিপত্রঃ-

আশুরা অর্থ কি

আশুরা মূলত আরবি শব্দ। আশারা শব্দমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ দশ। আরবি শব্দ আশরুন তথা দশ শব্দটি থেকে আশুরার শব্দের উৎপত্তি। মহররমের দশ তারিখ সম্মানিত বলে এই দিনটিকে আশুরা বলা হয়। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম এই দিনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র হযরত ইমান হোসেইন (রাঃ) এবং তার পরিবার ও অনুসারীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তের ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

আরো পড়ুনঃ- নরমাল ডেলিভারি কি। নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সহজ উপায় 

এই ঘটনা স্মরণ করে বিশ্ব মুসলিম যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করে থাকে। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নাত রাখতে তাদের এই আত্নত্যাগ মানবতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার সুন্দর বাণী সবাইকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা জোগায়। 

মহররম মাস মর্যাদাপূর্ণ কেন

আল্লাহর মর্যাদাপূর্ণ চার মাসের প্রথম মাস মহররম এর ১০ তারিখ রোজা পালন ও আমল সম্পর্কে হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ মর্যাদার কারণেই আল্লাহ তাআলা নিজে এই মাসের নামকরণ করেণ "মহররম "। আরবির এই মাসকে " সফরুল আউয়াল " তথা প্রথম সফর নামকরণ করে নিজেদের ইচ্ছা মতো যুদ্ধ -বিগ্রহসহ বিভিন্ন কাজকে হালাল ও হারাম করতো। অবশেষে আল্লাহ তাআলা এ অবস্থাকে নিষিদ্ধ করে এ মাসের ইসলামিক নামকরণ করেন "শাহরুল্লাহিল মুহাররাম" তথা মহররম আল্লাহর মাস। এই মাসের ১০ তারিখই নিঃসন্দেহে আশুরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদার দিন। আশুরার দিনটিকে মুসলিম উম্মাহকে পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কারণে মুসলিম উম্মাহ এই দিনটিকে বিশেষ আমল তথা রোজা পালনের দিন হিসেবে শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকে। 

আশুরা কবে ২০২২

মুসলমানদের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িয়ে আছে পবিত্র আশুরা। যার কারণে যখন আরবি মাসের শেষ মাস জিলহজ মাসের শেষের দিকে আসে এবং নতুন বছরের আগমণ ঘটতে চলে। এবং সামনে অপেক্ষা করে নতুন বছরের ক্যালেন্ডারের মাস ও বছর। আর সেই নতুন বছরের প্রথম মাস হচ্ছে আরবি মহররম মাস। যে মাসে রয়েছে পবিত্র আশুরা তাই সকল মুসলিম উম্মাহ জানতে চায় পবিত্র আশুরা কবে এবং কোন দিন পালিত হবে। বাংলাদেশে ৯ই আগস্ট ( মঙ্গলবার) পবিত্র আশুরা পালিত হবে। বাংলাদেশের আকাশে শুক্রবার ১৪৪৪ হিজরি সনের পবিত্র মহররম মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই শনিবার পবিত্র জিলহজ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হবে। আগামী ৩১ জুলাই ( রবিবার)  থেকে ২০২২ সালের পবিত্র মহররম মাস গণনা করা শুরু হল।

আশুরার ইতিহাস ও ফজিলত 

এই মাসের দশ তারিখকে বলা হয় পবিত্র আশুরা। মহররম মাসের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়।, মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ১০ই মহররম ইতিহাসে খুবই শোকাবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। কারণ এই দিন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতি ইমাম হোসেন কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। তাছাড়াও আশুরার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় অন্যান্য বিভিন্ন কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে বলা হয়ে থাকে এই দিনে আমাদের প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাছাড়া পবিত্র আশুরার এই দিনে আল্লাহ তাআলা আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন।

আরো পড়ুনঃ- নতুন করে ইউটিউব চ্যানেল খোলার নিয়ম। প্রফেশনাল ইউটিউব চ্যানেল খোলার নিয়ম 

আর কারবালা হলো ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে একটি ঐতিহাসিক প্রান্তর, যেখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র হযরত  ইমাম হোসাইন (রাঃ) তার পরিবারবর্গ ৬১ হিজরির দশ মহররমে ইজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন।" মহররম মাসের কথা শুনলে মনে হয় আশুরার কথা"। আর আশুরা  মানেই আমাদের অঞ্চলে মনে করা হয় কারবালায় হৃদয় বিদায়ক ঘটনা। কিন্তুু আশুরা মানেই কারবালার ঘটনা নয়। আশুরার প্রতিপাদ্য হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহ পালন করা। আশুরা সেই দিনটিকে বলা হয়, যে দিন তাওহীদ শিরকের ওপর বিজয়ী হয়েছিল। 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই দিনের তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন এবং পবিত্র আশুরার দিনে কী করণীয় তাও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। ১০শে মহররম সংঘটিত অলৌকিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধর্মীয় ঘটনার কারণেই মুসলমানদের কাছে আশুরার দিবসটি বিশেষভাবে মহিমান্বিত। বছরের শ্রেষ্ঠতম মাস রমজান এই মাসের পর মহররম মাসের ফজিলত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, "ইন্না ইদ্দাতাশ শুহুরি ইন্নাল্লাহিছনা আশরা শাহরা, ওয়ামিনহুম আরবাআতুন হুরুম"।  এই অর্থ আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। 

তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়।এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আঃ) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হযরত মুসা (আঃ) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন, হযরত মুসা (আঃ) এর কৃতজ্ঞতা অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক বেশি হকদার। তারপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং তার উম্মতকে রোজা রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।

আশুরার রোজা

এদিনে আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং তার জাতিকে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এই উপলক্ষে ইসলামের আগমের আগে থেকেই ইয়াহুদীরাও রোজা রাখতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদীদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আশুরা উপলক্ষে ইয়াহুদীরা একদিন রোজা রাখতো।

মহররম মাস ত্যাগ ও আদর্শের সেই বার্তায় স্মরণ করিয়ে দেয়। যা প্রত্যেক মুমিন মুসলমান হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। পবিত্র এই মাস আলোকিত হয়েছে আশুরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতপূর্ণ সিয়াম সাধনায়। 

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। "রমজানের পর সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ রোজার মাস হল আল্লাহর মাস মহররমের রোজার মাস"। 

হাদিসে বর্ণিত মহররমের রোজাটি মূলত ১০ই মহররম তথা আশুরার রোজা। মহররমের মর্যাদা এবং বরকতের উৎসও এদিন রোজা রাখা।

হযরত আবু কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনায় আছে আশুরার রোজার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল তিনি বললেন" আশুরার রোজার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী " আশুরার রোজা বিগত বছরের পাপসমূহ মোচন করে দেয় "। 

আশুরার রোজা সব নবী রাসুলের আমলেই ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন " ইয়াহুদীরা এই দিনে রোজা রাখছে। তিনি রোজা রাখার কারণ জানলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে বলেন,"মুসা আলাইহিস সালামের সাথে আমাদের সম্পর্ক ইয়াহুদীদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য"। তাই নবী বললেন তোমরাও রোজা রাখ।

আশুরার দুইটি রোজা রাখা সুন্নাত 

আশুরা উপলক্ষ্যে দুইটি রোজা রাখা সুন্নাত। রোজা রাখার পদ্ধতি হল মহররমের ৯ থেকে ১০ কিংবা ১০ থেকে ১১ তারিখ রোজা রাখা। এই রোজা রাখলে পুরো এক বছরের গোনাহ মাফ করে দিবেন বলে আশীর্বাদী ছিলেন বিশ্বনবী।

আশুরায় ছোট বাচ্চাদের রোজা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারি সাহাবাগণের গ্রামগুলোতে দূত পাঠিয়ে এই রকম ঘোষণা দিতে বলেন, যে ব্যক্তি সকালে কিছু খেয়ে ফেলেছে সে যেন বাকি দিন না খেয়ে পূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তি না খেয়ে আছে সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। তিনি (রুবাইয়্যের বলেন, এরপর আমরা রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদের রোজা রাখাতাম। আর তাদেরকে তুলা দ্বারা বানানো খেলনা দিতাম। যখন তারা খানার জন্য কাঁদতো তখন তাদেরকে খেলনা দিয়ে ইফতার পর্যন্ত ভূলিয়ে রাখতাম। যাতে তারা রোজা পূর্ণ করে। 

মহররমের আমল

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি রমজানের পর আরও কোন মাসে রোজা রাখতে চাও তবে মহররমের রোজা রাখ। কেননা সেটি আল্লাহর মাস। এই মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা অনেকের তাওবা কবুল করেন। ভবিষ্যতে ও আরো অনেক মানুষের তাওবা কবুল করবেন। আশুরারদিন রোজা রাখা মহররমের অন্যতম আমল।

মাসজুড়ে দোয়ার আমল

মাসজুড়ে তাওবা করা এবং কল্যাণ লাভে এই দোয়া পড়া আবশ্যক। 

উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালঅমাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়নিম মিনার রাহমানি, ওয়াঝাওয়ারিম মিনাস শায়ত্বানি।

বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা

রাব্বানা জ্বালামনা আংফুসানা ওয়াইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুন্না মিনাল খাসিরিন।

অর্থঃ- হে আমাদেন প্রভু। আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।

সব সময় ইসতেগফার পড়া

উচ্চারণঃ- আসতাগফিরুল্লা হাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম ওয়া আতুবু ইলাইহি; রাব্বিগফিরলি ওয়াতুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আংতাত তাওয়্যাবুল গাফুর।

আশুরার রোজার ফজিলত 

আশুরার রোজা রাখার ফজিল অনেক বেশি। এই দিনে রোজা রাখার ফজিলত বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি বিগত এক বছরের সকল গোনাহ মাফ করে দিবেন। 

পরিশেষে বলা যায় 

- আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরার রোজা পালন ও আমলসহ মাসব্যাপী দোয়া ও তাওয়াহ ইসতেগফারে অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। আমার কোন ইনফরমেশনে যদি ভুল থাকে ক্ষমা করবেন আর আমাকে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। ধন্যবাদ




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url